জাপান, ইন্দোনেশিয়া, গুয়াতেমালারমতো দেশগুলোতে প্রায় প্রতিদিন ভুমিকম্প হয়, তাই তারা এইসব মৃদু ভুমিকম্পকে খুব একটা আমলে নেয় না। তবে বিল্ডিং তৈরির ক্ষেত্রে ভিত্তিটা অনেক শক্ত করে। যত উঁচু বিল্ডিং তত শক্ত ভিত্তি, যেনো ৭/৮ মাত্রার ভুমিকম্পে কিছুই না হয়।
ভিয়েতনামের রাস্তার দুই ধার ধরে প্রচুর তেঁতুলগাছ দেখা যায়। ফ্রেন্স কলোনী থাকার সময় তখনকার গভর্নর প্রথম তেঁতুল গাছ লাগানোর কাজ শুরু করেন। প্রখর রৌদ্রের সেই দেশে রাস্তায় চলতে গিয়ে যেনো একটু ছাঁয়া পাওয়া যায় তাই ঘন পাতার এই গাছ তাঁরা লাগিয়েছিলেন। এমন অনেক গাছ থাকার পরেও তাঁরা তেঁতুল গাছ লাগিয়েছিলেন, কারণ তেঁতুল গাছের মূল অনেক সবল, প্রচন্ড ঝড়েও এই গাছ উপড়ে যায়না।
গাছের ক্ষেত্রে মূল বা মৌল আর বিল্ডিং এর ক্ষেত্রে ভিত্তি বলা হলেও কোনো কোম্পানির মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই দুইটি শব্দ যুক্ত করে কেনো যে মৌলভিত্তি বলা হয় সেটা ঠিক আমার এই ক্ষুদ্র মাথায় ধরেনা। বিষয়টা যেনো “ক্যাচ ধরার” মতো। দুইটি শব্দের একটি অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত। তবে শক্ত মৌলভিত্তি বলতে কি বোঝায় উপরের এই উপমা দিয়ে সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছি।
একই রকমের উপমা খুঁজতে হলে দুর্বল মৌলভিত্তির জন্য কুঁড়ে ঘর আর তার পাশের কলাগাছের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
প্রশ্ন হলো এই তেঁতুল দিয়ে আমি কি করবো? ভারত ও আফ্রিকায় তেঁতুল দিয়ে অনেক ধরণের খাবারের রেসিপি তৈরি হলেও বাজারে নিয়ে যত সহজে কলা বেচতে পারবো, আমি কি তেঁতুল তত সহজেই বিক্রি করতে পারবো? তাছাড়া কুঁড়ে ঘরের মানুষ আমি, দিন এনে দিন খাই, নিজের অনেক চাহিদা মেটাতে পারিনা, সেখানে সঞ্চয় করা এক কাল্পনিক ব্যাপার, তাই দীর্ঘদিন টাকা আটকে রাখা অসম্ভ। সুতরাং আমি কলা বেচতেই চাই।
শেয়ার বাজারের কলা বিক্রেতা হচ্ছে তাঁরা, যাঁরা আজ কিনে পরশু বিক্রি করতে চান। কিন্তু সেটা করতে হলে কি যেনো এক কৌশল শিখতে হয়, টেকনিক্যাল না ফেকটিক্যাল অ্যানালাইসিস। তো দুইদিনের এক প্রশিক্ষণে সাপোর্ট, রেজিস্ট্যান্স, ক্রয়-বিক্রয় সংকেত শিখলাম, আর সেইসাথে শিখলাম স্টপ লস।
সাপোর্ট পেলে লক্ষ্য রাখি আর সংকেত পেলে কিনি। কিন্তু কি এক আজব বাজার, কিনলেই সাপোর্ট ভেঙ্গে যায়। তাতে কি? একজায়গায় আমি দারুণ সফল, সেটা হচ্ছে স্টপ লস, তাই লসে বিক্রি করি। এভাবে স্টপ লস দিতে দিতে বুঝলাম বাজারের মনস্তত্ব বুঝতে হবে। ততদিনে আমার যে দুইটি কুঁড়ে ঘর ছিলো, তা এখন একটি হয়ে গেছে।
এদিকে ওয়ারেন বাফেট মাসের পর মাস তেঁতুল টাইপের শেয়ার কিনেই যাচ্ছেন। দাম বাড়লেও কিনেন, কমলেও কিনেন। দাম বাড়তে বাড়তে অনেক উপরে উঠলে ক্রেতার ভীড় অনেক হয়ে গেলে যখন তিনি আর কিনতে পারেননা, তখন কম দামে কেনা তাঁর শেয়ারগুলির একটি বড় অংশ বিক্রি করে দেন। ফলে দর পড়ে যায়। পড়ে যাওয়া দেখে অনেকেই তাদের ক্রয় আদেশ তুলে নেন। ওয়ারেন বাফেট এবার আরো কিছু বিক্রি করে দিলেন। ফলে দর আরো পড়ে গেলো। এই দর পড়ে যাওয়া দেখে বাজারে প্যানিক তৈরি হলো। ফলে কলা বিক্রেতারা স্টপ লস দিতে থাকলেন। শেয়ার অবমূল্যায়িত হয়ে গেলে বাফেট আবার কিনে নিতে থাকলেন। এভাবে মাসের পর মাস কিনে বছরের পর বছরে অপেক্ষা করতে থাকলেন, একটি হ্যান্ডসাম ইপিএসএর আশায়।
এখানেই পার্থক্য
ফেসবুকে দেখি কলা বিক্রেতাদের অনেকেই “শেয়ার বিশেষজ্ঞ”; “শেয়ার ব্যবসায়ী”; “শেয়ার পন্ডিত” ইত্যাদি ইত্যাদি নামের আইডি খুলে প্রোফাইলে লিখে রাখে “ওয়াড়েন বাপেট হতি ছাই”। দেখে নিই ওয়ারেন বফেট কি করেননা যা এইসব শেয়ার বিশেষজ্ঞরা খুব বেশি বেশি করেন।
- ওয়ারেন বাফেটের কোনো ইমেইল নাই, ফেসবুকও নাই, এমনকি তাঁর অফিসে কিম্পিউটারও নাই। পক্ষান্তরে ফেসবুকের শেয়ার বিশেষজ্ঞরা একাধিক ইমেইল ও ফেসবুক আইডি থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় একটি করে পোষ্ট প্রসব করে।
- ওয়ারেন বাফেট মাসের পর মাস শেয়ার কিনে বছরের বছর অপেক্ষা করতে থাকেন। আর লভ্যাংশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। তাঁর শেয়ার বিক্রি করে পরবর্তীতে আবার কিনে যে ক্যাপিটাল গেইন করবেন, ১০ বছর আগের কেনা শেয়ার থেকে হয়তো তার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন, ফলে তিনি প্রায় আজীবনের জন্য শেয়ার ধরে রাখেন। পক্ষান্তরে আমার মতো কলা বিক্রেতারা আজ কিনে কাল বিক্রি করতে চাই, ফলে আমাদেরকে স্টপ লসের উপরেই থাকতে হয়।
- ওয়ারেন বাফেটের সারাদিনের একটি বড় অংশ অতিবাহিত হয় বই পড়ে। ফলে দেশের অর্থনীতি, বাজারের অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন। পক্ষান্তরে বিশ্বস্কুল থেকে বের হওয়ার পরে আমরা কয়েকবছর ধরে পুরো একটি বই পড়ে শেষ করতে পারিনা। অনেকে বই ছুঁয়েও দেখেননা।
- অত্যান্ত নরম স্বভাবের ওয়ারেন বাফেট হাসিমুখেই থাকেন। পক্ষান্তরে এখানের শেয়ার পন্ডিতেরা সারাদিন একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
- ওয়ারেন বাফেট তেঁতুলের ব্যবসা করেন যেনো বাজারের ঝড়ে উপড়ে না যায়, আর আমরা কলার ব্যবসা করি, তাই ঝড়ে সব শেষ হয়ে যায়।
ওয়ারের বাফেট কি, আমরা জানিনা, কিন্তু হতে চাই! জে সি লিভারমোরের মতো অনেকে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস করে সফল হয়েছেন, কিন্তু তাঁরাও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের কথা বলেছেন। আবার এইসব টেকনিক্যাল অ্যানালিস্টরা কয়েকবছরে যা আয় করেন, দেখা যায় তাদের অনেকেই এক বছরে তার বেশি হারিয়ে ফেলেন। সুতরাং সূত্র কেবল একটি “কম দামে কিনে অপেক্ষা করে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে, এবং সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে”।
তারপরেও আমি মাঝে মাঝে প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ দিয়ে যাবো, যদি ঝড়ে বক পড়ে তাই আর কি কেননা বাজারের মনস্তত্ব বুঝতে পারলে মাঝে মাঝে লাভ করা যাবে হয়তো।