খেলাধুলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক

যাদের জানার আগ্রহ প্রবল তাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি হয়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের যারা ফেসবুকে সক্রীয় তারাও অনেক প্রশ্ন করেন, তবে সে প্রশ্নের ভিন্নতা কম। গুনে গুনে তিনটি প্রশ্ন এখানে বারবার করা হয়।

১। শেয়ারটির দাম বাড়ছে কেনো?

২। শেয়ারটির দাম কমছে কেনো?

৩। শেয়ারটি কেমন হবে?


প্রথম দুটি অবশ্য আমার কাছে প্রশ্ন মনে হয়না, বরং হতাশা আর কান্না মনে হয়। দর বাড়তে থাকলে মনে হয়, ইশ ক্যান যে কিনলাম না আর কেনা শেয়ারের দর কমলে ভয়ে মনে হয় আরো বুঝি কমবে। বাচ্চারা কান্না করলে যেমন চকলেট দিলে থেমে যায় তেমনি এইসব প্রশ্নকারীদের জন্য চকলেট টাইপের কিছু উত্তর আছে, যা দিলে তারা থেমে যায়। সবচেয়ে পরিচিত ও টেস্টি চকলেটের নাম “আয়”। তাই প্রথম প্রশ্নের উত্তরে যদি বলি “আয় বেড়েছে তাই” এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যদি বলি “আয় কমেছে তাই” তাহলে তারা তাদের কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে যায়। এই বাজারে অনেক উদাহরণ আছে যেখানে আয় বৃদ্ধির পরেও দর কমেছে এবং আয় হ্রাসের পরেও দর বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং আয় যে একমাত্র নিয়ামক না, সেটা আমরা ভালোভাবে জানি। তবুও আয় যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, তাই আসুন আজ আয় নিয়ে আলাপ করি।


বিক্রয়লব্ধ আয়, পরিচালন মুনাফা বা আয় এবং নেট আয় এর মধ্যে আজ শুধুমাত্র বিক্রয়লব্দ আয় বা Revenue নিয়ে আলোচনা করবো।


কোনো পন্য বা সেবা বিক্রয় করে যে পরিমান টাকা পাওয়া যায় তা-ই হচ্ছে বিক্রয়লব্ধ আয়। ২০ টাকায় এক ডজন কলা কিনে ৩০ টাকায় বিক্রয় করলে এই ৩০ টাকাকে বিক্রয়লব্দ আয় বলা হয়। পন্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সহজভাবে বলা গেলেও সেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই আয়কে বিভিন্নভাবে সঙ্গায়ীত করা যায়। এখানেই শেয়ার বাজারের খেলা!


ধরুণ আপনার পরিবহণ ব্যবসা আছে। আপনি বিভিন্ন কারখানা থেকে পন্য ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে আনা-নেওয়া করেন। এখন নিচের কোন অবস্থানে আপনি আপনার আয়কে স্বীকৃতি দেবেন?

১। ট্রাক লোড হয়ে ফ্যাক্টরীর দরজা পার হলেই?

নাকি

২। পন্য গন্তব্যে পৌঁছালে?


প্রথম ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন, যেহেতু ট্রাক ও মাল দু্টোরই বীমা করা আছে, সুতরাং পথিমধ্যে যদি কোনো দুর্ঘটনাও ঘটে, তবুও আপনি টাকা পাচ্ছেন, সুতরাং ট্রাক লোড হয়ে ফ্যাক্টরীর দরজা পার হলেও আপনি ধরে নিচ্ছেন আপনার আয় হয়েছে বা আপনি আপনার আয়কে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, ইংরেজিতে যাকে বলে Revenue Recognition ।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন, যেহেতু ইন্স্যূরেন্সের টাকা তুলতে অনেক সমস্যা আছে এবং সেই টাকা আপনি কবে পাবেন, তা নিশ্চিত নন, তাই পন্য না পৌঁছানো পর্যন্ত আপনি আপনার আয়কে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না বা Revenue Recognize হচ্ছেনা।


আপনি আপনার কোম্পানির আয় বেশি দেখানোর জন্য প্রথম আয়কে স্বীকৃতি দিতে পারেন। আয় বেশি দেখাতে পারলে আপনার শেয়ারের দাম বাড়তে পারে।


বাজার থেকে শেয়ার সংগ্রহের জন্য আপনি আপনার কোম্পানির শেয়ারের দাম কমাতে চাচ্ছেন। আপনার কোম্পানির আয় কম দেখালেই শেয়ারের দাম পড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আপনি দ্বিতীয়ভাবে আয়কে সঙ্গায়ীত করতে পারেন।


ধরি, কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরে পথিমধ্যে অনেক বেশি দুর্ঘটনা আর কার্গোচুরির ঘটনা ঘটলো। দ্বিতীয়ভাবে আয়কে সঙ্গায়ীত করে আপনি আপনার কোম্পানির আয় অনেক কম দেখাতে পারলেন। কম আয়ের কারণে আপনার শেয়ারের দর কমতে কমতে তলানীতে গিয়ে ঠেকলো। এই সূযোগে আপনি আপনার আত্মীয়সজন মিলে প্রচুর শেয়ার কিনে রাখলেন। বছর দুয়েক পরে দেখা গেলো এবার দুর্ঘটনার পরিমান কম। এছাড়া আগের দুই বছরের দুর্ঘটনাকবলিত কার্গোর ইন্স্যূরেন্সের টাকাও পেলেন। এইবারও আপনি দ্বিতীয়ভাবে আয়কে সঙ্গায়ীত করলেন, দেখা গেলো গত বছরের চেয়ে এই বছর আয় ২০% বৃদ্ধি পেলো। কিন্তু আপনি যদি এবার প্রথমভাবে আয়কে সঙ্গায়ীত করেন, তবে দেখা যাচ্ছে আগের বছরের চেয়ে ২০০% আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে! আপনি তা-ই করলেন, শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেলো ৫০০%! আপনিসহ আপনার আত্মীয়সজনেরা শেয়ার বিক্রি করতে থাকলেন। দুই বছরে ৫০০% লাভ!


কিন্তু এভাবে কি বছর বছর আয়ের সঙ্গার পরিবর্তন করা যায়? উত্তর হচ্ছে “যায়”, বিশেষ করে আমাদের মতো এই চরম স্বাধীন দেশে।


অন্যান্য যে কোনো কোম্পানির চেয়ে ব্যাংকগুলোকে বেশি নিয়মের মধ্যে চলতে হয়। তারপরেও আমরা দেখেছি গতবছর সিটি ব্যাংক সম্পদ মূল্যায়নে “রিভ্যালুয়েশন মডেল” থেকে “কস্ট মডেল” এ পরিবর্তন করে!


এই ধরনের ফাঁকি কোম্পানির পক্ষে সম্ভব হলেও মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে অনেক কঠিন। তবে সেখানে আছে অন্য ফাঁকি, যেটা না হয় অন্য কোনোদিন আলোচনা করা যাবে।


তাই যত খারাপ শেয়ারই হোক না কেনো একেবারে কম মূল্যে কিনতে পারলে সেখান থেকেও লাভ করা যায়। পরিচালকেরা তাদের হাতের শেয়ার বন্টনের জন্য কখনো আয় বেশি দেখিয়ে কখনো আবার ভুয়া খবর দিয়ে শেয়ারের দাম আকাশে তুলে। তবে মৌলভিত্তি বিচারে আমার বিবেচনায় কিছু কিছু শেয়ার অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ তাই মামুরা যতই খেলাধুলা করুক না কেনো এদের ফাঁদে পা না দেয়ায় ভালো। এই ধরণের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারের লিস্ট এখানে দিয়ে দিলাম॥ আমার বিবেচনা অবশ্যই আপনার বিবেচনা থেকে ভিন্ন হতে পারে।


কোনো প্রশ্ন, মন্তব্য বা উপদেশ? অগ্রীম ধন্যবাদ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *