বাজারের ধসে সবার টাকা যেখানে জলীয় বাস্পের মতোই উড়ে যেতে থাকে, সেখানে Jesse Livermore সেই ক্র্যাশ এর সময় মাত্র ১ দিনে ১ মিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন একেবারে শূন্য থেকে! সেই ক্র্যাশের শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর মোট আয় হয় তিন মিলিয়ন ডলার!
অ্যামেরিকার দরীদ্র কৃষক পরিবারে ১৮৭৭ সালের ২৬শে জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন জেসি লিভারমোর। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পড়তে শিখেন এবং পাঁচ বছর বয়স থেকে নিয়মিত অর্থনীতির সংবাদপত্র পড়তেন! গ্রামার স্কুলে ভর্তি করা হলেও তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিলো অংক ও সংখ্যায়। অংকের যে বিষয় শিখতে সবার তিন বছর সময় লাগে, লিভারমোর সেটা শিখেছিলেন মাত্র এক বছরে।
কৃষকের ছেলে হবে কৃষক, সেটায় নিয়ম! ১৪ বছর বয়সে কৃষক বাবা লিভারমোরকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন, কিন্তু অংকে নেশাগ্রস্থ লিভারমোর কিছুতেই তা মেনে নিতে পারেননি। গৃহিনী মা তাই লিভারমোরকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন। পালানোর সময় হাতে দিয়েছিলেন ৫০ সেন্টস, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১০০ ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় মাত্র ১০০০০ টাকা!
১৪ বছর বসয়সেই তার প্রথম চাকরি হয় একটি ব্রোকারেজ হাউজে। সংখ্যার খেলা যার প্রতিটা রক্তবিন্দুর সাথে মিশে আছে, তার জন্য এটা ছিলো খুবই উপভোগ্য চাকরি। প্রতিটা শেয়ারের মূল্য তিনি তার নোটবইয়ে প্রতিদিন লিখে রেখে বিভিন্ন প্যাটার্ন খুঁজে নিতেন।এটা করতেন শুধুই শখের বশে! টাকার অভাব থাকাতে তিনি বাজারে বিনিয়োগের কথা তখনও চিন্তা করেননি। হঠাৎই একদিন জানতে পারলেন Bucket Shop এর কথা।
Bucket Shop এ আপনি একটি শেয়ারের দাম বাড়বে না কমবে, সে বিষয়ে বাজি ধরতে পারেন। এখানে বাজি ধরতে খুবই নগন্য টাকার দরকার হয়। এছাড়া সেই টাকার উপর আবার বাকেট শপগুলো মার্জিন লোন দেয়। লিভারমোর দেখলেন এটাই সুযোগ। দারুণ সফল হয়ে, তিনি তার চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। ১৫ বছর বয়সে সেখান থেকে তাঁর মোট আয় হলো ১০০০ ডলার, আজকের দিনে যা প্রায় ২৫০০০ ডলার। এভাবে ১০০০ থেকে তাঁর আয় বেড়ে দাড়ালো ২০ হাজার ডলারে। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। কিন্তু বাকেট শপগুলো যখন দেখলো তাদের টাকা আস্তে আস্তে লিভারমোরের কাছে চলে যাচ্ছে, তখন তারা লিভারমোরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে শুরু করলো। ২১ বছর বয়সে বাজিতে হেরে ২০ হাজার টাকা পরিনত হয় ২৫০০ ডলারে। ইতোমধ্যে বোস্টনের সব বাকেট শপ তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই ২৫০০ ডলার নিয়ে বোস্টন ছেড়ে পাড়ি জমালেন নিউইয়র্কে।
তিনি বলেন, ৭০% ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম মেনে সফল হয়েছেন, কেবল সেগুলোতেই স্থির থাকলে তাঁর কখনোই লোকসান হতোনা। যখনই তিনি অকারণে এই নিয়মের বাইরে বের হয়েছেন, তখনই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
নিউইয়র্ক স্টক এক্সেঞ্জে বিনিয়োগ করে খুব অল্প সময়ে তিনি খ্যাতির শিখরে উঠে গেলেও আবার অল্প সময়ে সব অর্থ হারালেন। তিনি বুঝলেন Bucket Shop এর কৌশল শেয়ার বাজারের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়।
পাঠক, এখানে একটি কথা না বললেই নয়। বাজি ধরে একটি শেয়ারের মুভমেন্ট সঠিকভাবে বলতে পারা আর ঐ শেয়ারে বিনিয়োগ করে সফল হওয়া দুইটি ভিন্ন বিষয়। ঠিক তেমনিভাবে অ্যানালাইসিস করে শেয়ারের মুভমেন্ট সঠিকভাবে বলতে পারা আর সেই শেয়ারে বিনিয়োগ করে লাভ তুলে নিতে পারা এক বিষয় নয়। দুটো এক বিষয় হলে ট্রেইনারগুলোর বেশিরভাগই হয়তো ট্রেনিং দেয়া বাদ দিয়ে কেবল ট্রেড করেই মাঝে মাঝে হাওয়াই দ্বীপে হাওয়া খেয়ে বেড়াতো!
লিভারমোরের জীবনের পরবর্তী অধ্যায় আরো আকর্ষণীয় এবং পৃথিবীর সব বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই শিক্ষণীয়। নিউইয়র্কে ব্যর্থ হয়ে তিনি আবার বাকেট শপে ফিরে যেতে চাইলেন। যেহেতু তিনি বোস্টনের বাকেটশপগুলোতে নিষিদ্ধ, তাই তিনি এবার গেলেন সেন্ট লুইসে যেখানে কেউ তাঁকে চিনবেনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানেও সবাই তাঁকে চিনে ফেললো, ফলে নিষিদ্ধ হলেন সেখানেও। তাই এবার তিনি নিজে বাজি না ধরে অন্যদেরকে দিয়ে সেই বাজি ধরালেন। বিনিময়ে তিনি নিলেন লাভের কিছু অংশ! এভাবে আবার টাকা হলে, আবার ফিরে গেলেন নিউইয়র্কে।
যদিও জেসি লিভারমোর শেয়ার বাজারে একটি পরিচিত নাম কিন্তু তিনি খ্যাতির শিখরে উঠে গেলে ১৯০৭ সালে যখন বাজারে ধস নেমে এলো। এক দিনে তিনি শর্ট সেল করে ১ মিলিয়ন ডলার আয় করলেন। ধস শেষ হওয়া পর্যন্ত তার মোট আয় হলো ৩ মিলিয়ন ডলার!
যার মেধা আছে তার জন্য কোনো শক্তি কি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? সব প্রতিকুল পরিবেশ তাদের জন্য অনুকুল হয়ে ওঠে। স্কুল শুরু করতে না করতেই যাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিলো, সেই লিভারমোরের সাহায্য চাইলেন জগৎ বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান JP Morgan ! যৌথভাবে বাজারকে ঠিক করার দায়িত্ব গ্রহনে লিভারমোর খুবই খুশি হলেন। তিনি জানতেন বাজার আরো গভীর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে, তাই তিনি ঝুঁকি এড়িয়ে যতটুকু সম্ভব তত শেয়ার কিনতে থাকলেন। বাজার আবার আস্তে আস্তে তার গতি ফিরে পেতে শুরু করলো। তাঁর নেতৃত্বে যারা শেয়ার কিনলো তারাও তাদের পকেটে অনেক মুনাফা তুলে নিতে সক্ষম হলো। কারো কারো জন্য লিভারমোর একটি ব্র্যান্ড নেম এ পরিনত হলো, তিনি হয়ে উঠলেন এই বাজারের হিরো।
প্রচুর অর্থ তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলে, তিনি শুরু করলেন জাঁকজমকপূর্ণ আয়েশি জীবন, হয়ে উঠলেন অভিজাত শ্রেণির একজন; যেতে থাকলেন ধনীদের ক্লাবে, এই অবিবাহিত টগবগে তরুণের জীবন হয়ে উঠলো অভাবনীয় উপভোগ্য। তাঁর এই যাপিত জীবনকে আরো জৌলুশময় করতে আবার ফিরে গেলেন ট্রেডিং এ।
ট্রেডিং এ লিভারমোর কখনোই অন্য কারো পরামর্শ নিতেন না। নিজ বুদ্ধিতে, নিজের মতো বিশ্লেষণ করে, নিজে নিজেই শেয়ার কেনা বেচা করতেন। কিন্তু এবার তিনি সেই নীতিভ্রষ্ট হলেন। কোনো এক কটন ট্রেডারের পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কটন ইন্ডাস্ট্রির শেয়ার কিনতে শুরু করলেন। ঐসময় মূলত সেই কটন ট্রেডারসহ আরো সবাই তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছিলেন যা লিভারমোর কিনেই যাচ্ছিলেন। ১৯০৭ সালের ধসে লিভারমোর যে মুনাফা করেছিলেন, তার ৯০% হারালেন মাত্র ১ বছরে! ১৯১৫ সালে ১ মিলিয়ন ডলারের ঋণ মাথায় নিয়ে তিনি দেউলিয়া হয়ে গেলেন।
আবার লেনদেন শুরু করার জন্য তিনি কিছু সাহায্য চাইলে তাঁকে মাত্র ৫০০ টি শেয়ার লেনদেন করার অনুমতি দেয়া হলো। তিনি জানতেন এবার তাঁকে অতি সাবধানে নির্ভুলভাবে প্রবেশ করতে হবে। ৮ বছরের অভিজ্ঞ একজন সফল ব্যবসায়ী এন্ট্রি দেয়ার আগে এবার পুরো ৬ সপ্তাহ মনোযোগ দিয়ে বাজার নিরীক্ষণ করলেন। আবার তিনি অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নিতে সক্ষম হলেন। মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তিনি আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে শোধ করলেন তার সমস্ত ঋণ। ১৯১৭ সালে প্রায় প্রতিটা খবরের কাগজে শিরোনাম হলো “বিস্ময় বালকের অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন”!
১৯২২ সালে প্রথমবারের মতো লিভারমোরের সাক্ষাৎকার ছাপা হলো কতগুলো পর্বে। তিনি তাঁর আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহিত হলেন। ছাপা হলো তাঁর লিখিত বই “Reminiscence of Stock Operator”, বিনিয়োগকারীদের জন্য যা সর্বকালের অন্যতম সেরা বই হিসেবে আজও বিবেচিত। এই বইতে লিখিত হয় তাঁর জীবনের উত্থান-পতনের গল্প ও বিনিয়োগের আদ্যপান্ত।
Wall Street থেকে আরো আয় করার জন্য তিনি তার নতুন অফিসে নির্জনতার মধ্যে গবেষণা শুরু করলেন। ১৯২৯ সালে তিনি সেই একই প্যাটার্ন দেখতে পেলেন যা তিনি দেখেছিলেন সেই ১৯০৭ সালে। তিনি বুঝলেন বাজারের ধস আসন্ন। আবার সেই সুযোগ, তাই আবারও শর্ট সেল! আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি এবার দিন-রাত তাঁর অফিসেই থাকতে লাগলেন, আর শর্ট সেল করে অর্থের পাহাড় গড়তে লাগলেন। ধস শেষে তাঁর মোট আয় হলো ১০০ মিলিয়ন ডলার, আজকের দুনিয়ায় যা প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলারের সমান!
কিন্তু এখানেই শেষ নয়! যত দ্রুততায় তিনি এই অর্থ বানিয়েছিলেন, তার চেয়ে যেনো আরো দ্রুততায় তিনি তাঁর অর্থ হারাতে লাগলেন। কিন্তু এবারের কারণটি আর কেউ জানলোনা! শেষ স্ত্রীর অগাধ টাকা থাকার কারণে হয়তো তাঁর অর্থকষ্ট ছিলোনা, কিন্তু শেষের দিকে তিনি সফলতার পরিবর্তে বিফল ছিলেন বেশি! মৃত্যূর আগে তাঁর নিজের কোনো সম্পদ ছিলোনা! ১৮৭৭ সালের ২৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করা লিভারমোর ১৯৪০ সালের ২৮ নভেম্বরে ৬৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।