বিশ্বাস ও ব্যবসা


ঘটনা ১:

কলম্বাস যখন ইন্ডিয়া আবিষ্কার করতে গিয়ে ওয়েস্টইন্ডিজে গিয়ে উঠলেন তখন সেখানের আদিবাসীরা পাথর, তীর, বর্শা নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। কলম্বাস জানতেন যে তখন সূর্যগ্রহণ হবে। তাই উনি আদিবাসীদের বলেছিলেন, “আমরা আল্লাহর লোক, স্বর্গ থেকে এসেছি, তোমরা যদি আক্রমন কর তাহলে আমি সূর্যকে টেনে নিচে নামিয়ে ফেলবো”। কিছুক্ষণ পরে সূর্যগ্রহণ শুরু হলে আদিবাসীরা ভয়ে কলম্বাসদের প্রণাম করা শুরু করেছিলো আর দিয়েছিলো অনেক খাবার দাবার। জ্ঞানের অভাবে আদিবাসীরা কলম্বাসের কথা বিশ্বাস করেছিলো।
(এইটা আসলে একটি অসত্য ঘটনা। বই বিক্রির জন্য এইসব কিংবদন্তি বানানো হয়। তবে নিচে লেখা পরের ঘটনাটা সত্য)

ঘটনা ২:
আমার বন্ধুর বড় ভাই যখন খুলনা ভার্সিটিতে পড়ে, তখনও মোবাইল ফোনের বিস্তার ঘটেনি। একদিন মলিন পোষাকে এক লোক সেই ভাইয়ের কাছে এসে উপস্থিত। বলে, সে তারই গ্রামের লোক এবং দুর সম্পর্কীয় আত্মীয়, খুলনাতে এসে তার টাকাপয়সা ছিনতাই হয়ে গেছে, তাই বাড়ি যেতে পারছে না। কিছু টাকা দিলে ফিরে যেতে পারে। তারপর বন্ধুটির বাবা, চাচা, ফুফুসহ আরো অনেকের খবরাখবর দেয় সেই লোকটি। ফলে আমার বন্ধুর ভাই সহজেই বিশ্বাস করে কিছু টাকা দিয়ে তার বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে। লোকটির কথামতো বাবার কাছে নিজের ভালোমন্দের কিছু কথা লিখেও পাঠিয়ে দেয়। চিঠি নিয়ে এবার লোকটি গেলো বন্ধুর বাড়িতে, কিন্তু এবার একটু দামী পোষাকে। বাবার কাছে চিঠিটা দেখিয়ে বলে, “এই যে আপনার ছেলের চিঠি, আমি আপনার ছেলের হলের প্রভোস্ট। আপনার ছেলেতো অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট, সে দেশের মুখ উজ্বল করবে। সেতো শুধু পড়ে আর পড়ে। সামনে পরীক্ষা, তার বেশ কিছু টাকা লাগবে। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে ওকে আসতে না দিয়ে আমিই চলে এলাম”। ছেলের এমন প্রশংসা শুনে বাবার বুক গর্বে ভরে গেলো। কিন্তু এতো টাকা কোথায় পায়? তাই পোষা গরুটা বিক্রি করে দুইদিন পরে লোকটির হাতে টাকা তুলে দিলো।

এখানে ছেলে ও বাবা দুজনেই বিশ্বাস করেছিলো। লোকটির বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয়েছিলো প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও তার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে!

ঘটনা ৩:
বেশ আগের ঘটনা, তখন মোবাইলের চল ছিলো না। বাড়ির কর্তা অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার ঘন্টাখানেক পরে, এক ছেলে মুরগী-মাছসহ ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে গৃহকর্তীর হাতে তুলে দিয়ে বলে এইগুলো স্যার পাঠিয়েছেন, আমি স্যারের পিয়ন। ছেলেটি এও বলল, আজ দুপুরে কোন মেহমান নাকি স্যারের সাথে বাসায় খাবেন, তাই এগুলো রান্না করতে বলেছে। আধাঘন্টা পরে ছেলেটি আবার ফিরে এসে বলে, স্যার ডেক-সেটটি (টেপ রেকর্ডার) চেয়েছেন, অফিসে নিয়ে যেতে বলেছেন।

অফিসেরই তো পিয়ন, তাই সরল বিশ্বাসে দামী সেটটি ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন গৃহকর্তী !!

ঘটনা ৪:
জাতীয় পতাকা দিয়ে চোখ বাঁধা, সাদা শার্ট পরা অজ্ঞান ছাত্রটিকে দুই সহপাঠি দুই পাশ থেকে ধরে হসপিটালের দিকে ছুটছে যাচ্ছে, ক্যাপশনে লেখা, “চোখ তুলে ফেলেছে, শ্রেফ চোখ তুলে ফেলেছে”। আবার এক ভিডিও বার্তায় মুখ ঢাকা মেয়েটি অন্য মেয়ের ধর্ষণের খবর পৌঁছে দিচ্ছে। সরকারের হাতুড়ি বাহিনীর দ্বারা এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ যে নিত্যদিনের ঘটনা, তাই চোখ তুলে ফেলা বা ধর্ষনের ঘটনা বিশ্বাস করেছিলো অনেকেই। কিন্তু আমার মতো সন্দেহ করা যাদের অভ্যাস, তারা একটু মনোযোগ দিতেই দেখে চোখ তুলে ফেলা ছাত্রটির সাদা শার্টে বা মুখে কোনো রক্তের দাগ নাই, কিংবা ভিডিও বার্তা দেয়া মেয়েটির আচরণ একটু বেশি বেশি অভিনয় মনে হয়েছিলো।

যারা ঘটনাটা বিশ্বাস করেছিলো তারা বিশ্বাস করেই যাবে।  কারণ বিশ্বাসের ধরণটাই এমন, এখানে কোনো যুক্তি মানে না।

জ্ঞান মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় আর বিশ্বাস মানুষকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে শেখায়। তবু্ও মানুষ বিশ্বাস করে, কারণ সরল বিশ্বাসী এই সাধারণ মানুষগুলির বেশিরভাগই সৎ হয়, আর সৎ মানেইতো বোকা!!

গুজব ছড়িয়ে এহেন সরল বিশ্বাসী মানুষদের মাঝে উচ্চ মূল্যে শেয়ার ধরিয়ে দেয়াটা খুবই সহজ। তাই পরিচিত কিছু কিছু ব্যবসায়ী অনেকেই বলেন, অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এই দেশে শেয়ার ব্যবসা করা নাকি সহজ! এই সাধারণ মানুষদেরকে দিতে হবে লোভ আর ভয় – ব্যস কাজ হয়ে গেলো।

ঘটনা ৫

২০১৭ সালের প্রথমদিকে, একটি অনলাইন পত্রিকা থেকে সংবাদ প্রকাশ করা হয় যে UNITEDAIR এ বিদেশী এয়ারলাইন্স কোম্পানি বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, অল্প দিনেই এই বিমান আকাশে উড়বে। বিদেশী সংস্থার সাথে UNITEDAIR এর যে চুক্তি হয়, সেটার স্ক্যান কপিও পাবলিশ করা হয় ঐ অনলাইন পত্রিকায়। কিছুদিন পরে ডিএসই এর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই কোম্পানিতে বিদেশী বিনিয়োগ শূণ্য থেকে ১২.১৮% হয়। স্বাভাবিক ভাবেই সরলবিশ্বাসীদের মনে এইটার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।

এভাবে কখনো আসে মালিকানা পরিবর্তনের গুজব; কখনো আসে তেলের দাম পড়ে যাওয়ার গুজব; সরল বিশ্বাসীদের কখনো দেয়া হয় লোভ আর কখনো দেয়া হয় ভয়।

বিশ্বাস বড় অদ্ভুত! তাই যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, মানুষ চাঁদে যায়নি, সেই একই ব্যক্তি আবার বিশ্বাস করে যে, নীল আর্মোস্ট্রং চাঁদে আযান শুনেছেন! এই সকল বিভ্রান্ত-দিশেহারা মানুষগুলো এই বাজারে কেমন ব্যবসা করতে পারে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *