একটি দেশের শেয়ারবাজার হচ্ছে সে দেশের অর্থনীতির দর্পণ। শেয়ারবাজারে সে দেশের অর্থনীতির চিত্র প্রতিফলিত হয়। আমি কথাটা মনে প্রাণেই মানি। তবে তার পরে যে কথাটুকু বলা হয় সেটাতে দ্বিমত আছে। পরের কথাটা হচ্ছে “অর্থনীতি ভালো হলে শেয়ারবাজার ভালো হয়”।
আমি যখন দর্পণের সামনে উত্তর দিকে মুখ করে দেখি তখন আমার প্রতিবিম্ব ঠিক দক্ষিণ দিকে মুখ করে থাকে। সুতরাং একটি দেশের অর্থনীতি উত্তরমুখী হলে শেয়ারবাজার যদি তার প্রতিবিম্ব হয় তবে শেয়ারবাজারের সূচক দক্ষিণমুখী হবে। অর্থনীতি আর শেয়াবাজার দুটোই যদি উত্তরমুখী বা উর্ধ্বমূখী হয় তবে সেটাকে কি আর প্রতিবিম্ব বলা যাবে? তাহলে শেয়ারবাজার আবার দর্পন হয় কিভাবে? দুটো বিপরীতমুখী থাকে বলেই শেয়ারবাজার হচ্ছে অর্থনীতির দর্পন।
ভাবনা-১:
কোভিড পূর্ব কয়েকবছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। বেকারত্ব বেড়েই যাচ্ছিলো। তবে যে বেকারত্ব দেখানো হচ্ছিলো প্রকৃত বেকার ছিলো আরো বেশি। আমার এক অ্যামেরিকান কলিগ একবার বলতেছিলেন তাঁর অনেক বন্ধু চাকরী পায়নি বিধায় লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলো। পড়ালেখার উপরে সেখানে ঋণ পাওয়া যায়। তাই চাকরী না পেলে ঐ ঋণ নিয়ে আরো উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য লেখাপড়া করে জীবনটাও চালিয়ে নিতে পারে। সুতরাং বেকারের খাতা থেকে এদের নাম উঠে যায়। শর্ত হচ্ছে, চাকরী পাওয়ার পরে ঋণ পরিশোধে বেতন থেকে টাকা কাটতে থাকবে।
বিগত কয়েকবছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দক্ষিণমুখী হলেও শেয়ারবাজার কিন্তু উত্তরমুখী ছিলো !
ভাবনা -২:
২০১৯ সাল ভারতের অর্থনীতি ছিলো চরম হতাশার। একেবারে গর্তে ঢুকে গেছে। কিন্তু শেয়ারবাজার ফুলে ফেঁপে ক্রমেই উত্তরমুখী হচ্ছিলো। এই উর্ধপানে ছুটার কারণ কি?
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের শেয়ারগুলোর দর ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছালে Kejriwal Research এর প্রতিষ্ঠাতা জনাব Kejriwal বললেন, “It is a dichotomy, economy is bad but markets are up, the guiding sentiment is that there is hope that things will get better going forward!
সুতরাং এই বৈপরীত্বের কথা জনাব কেজরিওয়ালও স্বীকার করলেন!
ভাবনা-৩:
একটি কোম্পানির শেয়ার সাংহাই ও সেনজেন স্টক মার্কেটে যে মূল্যে লেনদেন হয়, সেই একই কোম্পানির শেয়ার হংকং এর শেয়ার মার্কেটে বেশি দামে লেনদেন হয়। একই টাকায় হংকং এর চেয়ে সাংহাইতে কয়েকগুন বেশি শেয়ার লেনদেন করা যায়। কেনো এমন হয়! এ ব্যাপারে তিন-চারটি তত্ত্ব আছে তবে সে তত্ত্বের কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি।
২০১৮ সালে আমাদের বাজারে দর পড়তে থাকলে একজন বিশ্লেষক টিভিতে এসে তত্ত্ব দিয়েছিলেন “এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির খাদ্যের সংকুলান করতে বিরাট অংকের টাকা বের হয়ে যাচ্ছে, তাই বাজার পড়ছে !“ – ঠিক এমনই অর্থহীন চীনের সেইসব তত্ত্ব। সেখানের জনগনের মগজে-মননে, মস্তিষ্কের নিউরণে-অনুরনে একটি ধারনা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে মৌলভিত্তির সাথে তাদের বাজার খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্রিটেনের দৈনিক ফাইন্যানসিয়াল টাইমস গত কয়েক দশকের তথ্য বিশ্লেষেণ করে দেখেছে যে কোম্পানির গ্রোথ প্রস্পেক্ট ও প্রফিট্যাবিলিটির সাথে চীনের শেয়ার বাজারের কোনো সম্পর্ক নাই। নিউজ প্রতিবেদনটির তাই তারা শিরোনাম করেছিলো “Fundamentals simply do not matter in China’s stock markets” লেখাটি ছাপা হয় ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারিতে। কেউ চাইলে ইন্টারেনেটে খুঁজে পড়ে দেখতে পারেন
সূত্র: https://www.ft.com/content/2362a9a0-3479-11ea-a6d3-9a26f8c3cba4
ভাবনা-৪:
দ্রুত প্রবৃদ্ধির বাংলাদেশের এই অর্থনীতির দিকে পৃথিবী অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রয়। ২০১৯ সালের পুরো বছর জুড়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বের বড় বড় নেতারা ভুয়সী প্রসংশায় ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এই ইকোনমিক গ্রোথ প্রস্পেক্ট দেখে এদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। অর্থনীতি যদি উত্তরমুখী হয় তাহলে দর্পণে কেমন দেখা যাবে? ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত ফ্লোর দেয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের বাজার কেবল পড়েই যাচ্ছিলো!
প্রমাণ-৫:
দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অগুণিত বেকার, উচ্চমাত্রার মুদ্রাষ্ফীতি এবং কোভিড সময়ের তেলের বাজার পড়তি – এমনই এক অর্থনীতির দেশ হচ্ছে ইরান। যে দেশের অর্থনীতির এতো খারাপ অবস্থা সেই দেশের শেয়ারবাজার কেমন হতে পারে?
বলা হয় Tehran Stock Exchange is the best performing equity market in the world. ইরানে ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারের সুচকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২৫ শতাংশ!
২০২০ সালের এই কোভিড অতিমারিতে পৃথিবীর সব শেয়াবাজারের পতন হলেও ইরানের বাজার যেনো আরো বেগবান হয়। যে দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাস্ক কেনার টাকা নাই; যে দেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাই নিজেরা নিজেরা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে ফান্ডগঠন করে মাস্ক কিনে; এবং সেই ডিস্পোজেবল মাস্ক ৭ দিন ব্যবহার করে, সেই দেশের শেয়াবাজার খাড়াভাবে উত্তরদিকে উঠতে থাকে।
কেনো?
কারণ শেয়ারবাজার হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির দর্পণ
এগুলো উদাহরণ না ব্যতিক্রম – তা বিচার করার ভার পাঠকের।