বৃত্তের বাইরে

আমরা আমাদের চিন্তা-ভাবনাতে কতটুকু স্বাধীন? অদ্ভুত প্রশ্ন! চিন্তা-ভাবনা আবার কখনো পরাধীন হয় নাকি! আমার চিন্তায় আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারি; আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারি আমারই ভাবনার আকাশে; কিংবা একদিনেই কিনে ফেলতে পারি পছন্দের কোম্পানির সব শেয়ার!

আসলেই কি তাই?

পরিকল্পনাটা গতকালই করা হয়ে গেছে, আজ তার বাস্তবায়ন। অফিস বিল্ডিং এর লিফটে উঠতেই মেহেদী সাহেব বলে উঠলেন, “কি ব্যাপার আকিজ ভাই, রাতে ঘুম হয়নি বুঝি? আপনাকে বেশ পরিশ্রান্ত লাগছে।” মেহেদীর কথাকে একেবাড়ে উড়িয়ে দিলেন আকিজ সাহেব, কারণ রাতে উনার খুবই ভালো ঘুম হয়েছে।

লিফ্ট থেকে নামতেই ফ্রন্ট ডেস্কে বসা রিসেপশনিস্ট ন্যান্সি বললেন “গুড মর্নিং স্যার, ভালো আছেন? অবশ্য বলতে হবেনা, আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আপনি খুব টায়ার্ড”। “এই তো আছি খুব ভালো” বলেই কার্ড পাঞ্চ করে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকলেন অফিসে।

হাতের বামের প্রথম ডেস্কে বসা দীপঙ্কর রয়ের সাথে চোখে চোখ পড়তেই উদ্বিগ্ন হয়ে রয় সাহেব বললেন “কি ব্যাপার আকিজ ভাই, অসুস্থ নাকি, অবশ্য যে গরম পড়েছে অসূস্থ না হয়ে উপায় আছে!”

আকিজ সাহেব এবার বিভ্রান্ত হলেন, “তাকে কি সত্যিই অসূস্থ দেখাচ্ছে”! নিজের ডেস্কে না গিয়ে চলে গেলেন ওয়াসরুমে। চোখে মুখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলেন, সোজা গিয়ে বসলেন নিজের ডেস্কে।

পাশে বসা হারুন সাহেব বললেন, “শুনলাম আপনি অসূস্থ, অফিসে এলেন কেনো? এখনতো কাজের চাপ কম, তো আপনার কাজগুলো না হয় আমিই করে দিতাম!”

প্রতিদিনের মতো এবারো কম্পিউটার অন করেই উনি গেলেন প্যান্ট্রিতে, যেখানে আগে থেকেই চা খাচ্ছিলেন মামুন আর মিলি। “অসূস্থ মানুষের একটু সেবা করি, দেন আপনার চা’টা আজ আমিই বানিয়ে দিই”, বললেন মিলি। চা খেতে খেতে গল্প হলো কিছুক্ষণ, তারপর ফিরলেন যে যার ডেস্কে।

আকিজ সাহেবের মাঝে এতক্ষণে একটু অবসাদের ভাব এসে গেছে। হন্ত দন্ত হয়ে ফাস্ট-এইড বক্স হাতে ছুটে এলেন রুনা ম্যাডাম, বললে “খুব বেশি খারাপ লাগলে প্রেশারের অসুধটা খেয়ে নিন”। এদিকে পাশা সাহেব বিপি মেশিন নিয়ে প্রেশার মাপা শুরু করেছেন। আকিজ সাহেবের ডেস্কের আশেপাশে ইতোমধ্যে ছোটোখাটো একটি জটলা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অফিসের বড় সাহেব জনাব ইশতিয়াক আহমেদ গুরুগম্ভীরভাবে বিরক্ত হয়ে বললেন, “এতো অসূস্থ হলে অফিসে আসার কি দরকার, পুলের গাড়িটা নিয়ে বাসায় চলে যান!” এসি রুমের মধ্যেও এখন আকিজ সাহেব ঘামছেন, আর পাশা সাহেব সমানে বাতাস করে যাচ্ছেন।

এটা ছিলো একটি পরীক্ষা, যেখানে আকিজ সাহেব ছাড়া আর সবাই অভিনয় করেছেন। একটি সুস্থ মানুষকে মাত্র তিন ঘন্টার ব্যবধানে বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছে যে তিনি অসুস্থ এবং এই অল্প সময়ে সত্যি সত্যি তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন!

আকিজ সাহেবের চিন্তা কি স্বাধীন ছিলো?

আমাদের কিছু কিছু চিন্তা একটি নির্দিষ্ট বলয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ, যে বৃত্তের বাইরে আমরা বের হতে পারিনা, যা কিনা পরিচালিত হয় সমাজের কর্তাব্যাক্তিদের দ্বারা। তাঁরা যেভাবে চাইবেন, আমরা ঠিক সেভাবেই চিন্তা করতে বাধ্য!

ঘটনা-১:

২০১৫ সালের ৯ টাকার শেয়ার ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ২৪ টাকায় উঠলে দাম পড়ে যাওয়া ছিলো অবধারিত। পড়েওছিলো!তারপর হঠাৎ হঠাৎ লাফিয় লাফিয়ে দাম বৃদ্ধি পেলেও দীর্ঘমেয়াদের পতনই যেনো পরিলক্ষিত হয়। এই পতন ত্বরান্বিত করতে ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ডিএসই এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ বেশ সহায়তা করে। অডিটর্স রিপোর্টে কিছু নেগেটিভ কমেন্ট দেখে বিনিয়োগকারীর আগ্রহ যখন শূন্যের কোঠায়, তখনি স্মার্ট মানি বাজার থেকে কিনে নেয় অসংখ্য শেয়ার। প্রতিদিনই সার্কিট ব্রেকার স্পর্শ করত করতে যখন দর একেবারে চুঁড়ায় উঠে যায়, তখন আসতে থাকে সুসংবাদের পর সুসংবাদ। ঐ বছর ১৬ সেপ্টেম্বরে DSE এর ওয়েবসাইটে PSI (Price sensitive information) দেয়া হয়, the Company has further informed that it has signed ‘Exclusive Commercial Agreement ‘ with Minfy Technologies Private Limited, India to provide Amazon Web Services in Bangladesh on exclusive basis with their collaboration and support. The Company has further informed that it has signed a ‘detailed Commercial Agreement ‘ with Ranial Systems Inc., Somerset, USA, for working together for pursuing different financially rewarding businesses in, specially, IT/IT enabled services, computer software/hardware, internet of things (IOT), Managed services, ERP, Intelligent Energy Management, Strategic Consulting and co-innovation, vertical applications. বাজার আমাদের ভাবতে শেখায় বা ভা্বতে বাধ্য করে যে INTECH, ২০০ টাকা ছুঁয়ে যাবে। আমরাও বিশ্বাস করি আর সমানে কিনতে থাকি শুধুমাত্র বিদেশীদের সাথে চুক্তি হওয়ার কারণে। বিদেশীদের কোম্পানি যেনো কখনোই লোকসান করে না! ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৭৪.৫ টাকায় উঠে তারপর শুরু হয় টানা পতন! ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবরে কোম্পনির শেয়ারটির লেনদেন শেষ হয় ১৩.৬ টাকায়! অর্থাৎ প্রায় ১৩ মাসের ব্যবধানে ৭৪.৫ টাকা থেকে মাত্র ১৩.৬ টাকায় দর পড়ে যায়!

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের চিন্তা কি আসলেই স্বাধীন?

ঘটনা-২:

২০১৬ সালের মে মাসের ৭০ টাকার শেয়ারের দর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০১৭ এর নভেম্বরে ১৭৮ টাকায় উঠলে একটু ভয়তো হয়ই, না জানি কখন দামটা ধপাস করে পড়ে যায়। ধপাস করে না পড়লেও ধীরে ধীরে পড়তে থাকে। সহজ সরল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের দর বাড়লে কিনে, পক্ষান্তরে দর কমলে বিক্রি করে। সরল বিনিয়োগকারীর এই সহজ আচরণকে খুব সহজভাবেই কুটিল বাজার ব্যবহার করে থাকে। তো সেই পড়তে থাকা দামটার প্রতি সেইসব সরল বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমাতে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। গতবছরের চেয়ে ৩৪% কম লাভ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যাতে বলা হয়, raw material এর দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও ফিনিসডগুডস এর দাম বাড়ানো হয়নি। এই খবর প্রকাশ করা হয় ডিএসই এর ওয়েবসাইটে ৩ মে ২০১৮ তারিখে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ভাবতে বাধ্য হয় যে, এই শেয়ারের দাম কমে যাবে। ঠিক সেই মুহুর্তে স্মার্ট মানি আরও সংগ্রহ কর নেয়। ২০১৬ এর নভেম্বর আর ২০১৭ এর জুলাইয়ের ভলিউ্যম দেখলেই অনুমান করা যায় আগেই স্মার্ট মানি কি পরিমান সংগ্রহ করেছিলো। পরবর্তী একবছর কিছুটা উত্থানপতনে থাকার পরে ২০১৮ সালের ১২ জুন থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে দর বাড় থাকে।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮: DSE এর ওয়েবসাইটে PSI দেয়া হয় The board of directors agreed and approved the EP Contract between Confidence Cement Dhaka Limited, an associate of Confidence Cement Limited and the China National Heavy Machinery Corporation (CHMC) for supply and delivery of necessary machines/equipments with accessories for Cement Mill (VRM). ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে দাম। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবরে শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর উঠে ২৪৩.৪ টাকায়! তারপর থেকে টানা দুই বছর দীর্ঘ পতন। ২০২০ সালের ১৮ মার্চে শেয়ারটির লেনদেন শেষ হয় মাত্র ৮৫.৯ টাকায়!

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের চিন্তা কি আসলেই স্বাধীন?

এরকম আরো ঘটনার উদাহরণ আছে!

শত কোটি টাকার এক একটি প্রজেক্ট শেষ হতে কত বছর লাগে? এক বছর, দুই বছর…? কত টাকা মুনাফা করা যায় সেই সব প্রজেক্ট থেকে?

শেয়ার বাজার থেকে যদি নিশ্চিতভাবেই তার চেয়ে বেশি মুনাফা করা যায় তবে স্মার্ট মানি কেনো দুই তিন বছরের জন্য এখানে বিনিয়োগ করবে না? আর তাই তলানীতে থাকা অবস্থায় এইসব ক্ষুদ্রদের, এইসব ভীতুদের, ভয় দিয়ে দাম ফেলে সংগ্রহ করা হয়, অন্যদিকে ঐ একই ক্ষুদ্রদের লোভ দিয়ে দাম বাড়িয়ে বন্টন করা হয়। আমরা অতি ক্ষুদ্ররা দাম বাড়ার সময় সেইসব ভালো ভালো, মন ভুলানো সংবাদ অনলাইন পত্রিকা থেকে পড়ে আনন্দে নৃত্য করতে থাকি আর নিজেদের জ্ঞানের গভীরতা তুলে ধরতে মুখস্ত করা ঐসব খবরের রেফারেন্স দিয়ে ফেসবুকে বুক চিতিয়ে বলতে থাকি এইটার দাম বাড়বে!!

শুধু বাংলাদেশ অফিস না, বরং বাংলাদেশের বাইরেও আমাদের সব অফিসে একটি কথা খুবই প্রচলিত “Think out of the box” – “বৃ্ত্তের বাইরে আমাদের চিন্তা করতে হবে”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *